যুক্তি ও ওয়াহয়ি এর মাঝে ইবনু তাইমিয়্যা

Arman Firman
16 min readJul 29, 2020
Background: FreeQuranEducation

কার্ল শারিফ আল-তোবগুই[i] ও ইয়াসির ক্বাদি[ii] এর ডক্টরাল থিসিসের একটা ওভারভিউ

প্রাথমিক তথ্য

দা বুক ইন ফোকাস

YK ও CSR এর গঠন

ইবন তাইমিয়্যার বইয়ের বিষয়বস্তু

দুই বইয়ের রেফারেন্স পর্যালোচনা

প্রাথমিক তথ্য

Carl Sharif el-Tobgui | Ibn Taymiyya on Reason and Revelation | McGill University | Brill | 2020 | 444 pages (লেখায় CSR দ্বারা চিহ্নিত)

Yasir Kazi | Reconciling Reason and Revelation in the Writings of ibn Taymiyyah: An Analytical Study | Yale University | Unpublished | 2013 | 364 pages (YK দ্বারা চিহ্নিত)

যে বইয়ের উপর দুজন কাজ করেছেনঃ

Taqi al-Din Ahmad ibn Taymiyya | Darʾ taʿāruḍ al-ʿaql wa-l-naql, aw Muwāfaqat ṣaḥīḥ al-manqūl li-ṣarīḥ al-maʿqūl | ed. Muhammad Rashad Salim | Dār al-Kunūz al-Adabiyya; Jāmiʿat al-Imām Muḥammad Ibn Saʿūd al-Islāmīyya | 11 vols. | 1979; 1979–1981 | 4046 pages.

কিঃ দা বুক ইন ফোকাস

ইবন তাইমিয়্যার দার আল-তা’আরুদ হল ফাখর আল-দ্বীন আল-রাযীর ৪ খন্ডে লেখা তা’সিস আল-তাক্বদিস এর সমালোচনা। এ নিয়ে ইবন তাইমিয়্যার আরেকটা গ্রন্থ আছে, বায়ান তালবিস আল-জাহমিয়্যা, যা তা’সিস আল-তাক্বদিস এর সম্পূর্ণ সমালোচনা — বর্তমানে ৮ খন্ডে পাবলিশড। দার আল-তা’আরুদ, যা তা’সিস আল-তাক্বদিস এর কেবল একটা পয়েন্ট এর সমালোচনা, বর্তমানে ১০ খন্ডে পাবলিশড। সেই, তাই না?

CSR এর মতে এটা ইবন তাইম্য্যার সবচেয়ে সেরা কাজ।[iii] বইটার ভাষা খুবই কঠিন আর অগোছালো। বারবার বইয়ে এক আলোচনা থেকে আরেক আলোচনায় লাফানো হয়। বিভিন্ন জায়গার এলোমেলো লেখা মিলিয়ে একটা কনসেপ্ট এর ব্যাপারে ইবন তাইমিয়্যা কি বলতে চাচ্ছেন তার সামগ্রিক ধারণা পেতে হয়।

মোট ৪৪ টা পয়েন্টে লেখা হয়েছে সমালোচনাটি। ৩৮ টা মৌলিক, বাকি ৬টি আগের গুলো++ বলা চলে।[iv]

বই আজ সফলভাবে পাবলিশড ক্যাম্ব্রিজের রাশাদ সালিম নামক একজন রিসার্চারের জন্য। একক প্রচেষ্ঠায় প্রথম খন্ড অনেক কষ্টে পাবলিশ করেন। তারপর মুসলিম বিশ্ব থেকে তাকে সাপোর্ট দেওয়া হয় যার ফলে পৃথিবীর যেসব লাইব্রেরীতে মুসলিমদের লেখার ম্যান্যুস্ক্রিপ্ট পাওয়া যায় সেসব জায়গায় ঘুরে ঘুরে দার আল-তা’আরুদ এর আলাদা আলাদা পাণ্ডুলিপি খুজে বের করেন। তার অসীম পরিশ্রমের ফলে ইবন তাইমিয়্যার অনেক গুলো কাজ পাবলিশ হয়।[v]

কিভাবেঃ YK ও CSR এর গঠন

YK, CSR থেকে অনেক সহজ। CSR এ কঠিন ভাষা ব্যাবহার করা হয়েছে। তবে CSR পড়লে আপনার মনে হবে আপনি মুভি দেখছেন (পড়ার পর যদি কারো এমন না মনে হয়ে থাকে — হয়তোবা আমার কাছে এমন লাগার কারণ এটা যে আমি জীবনে মুভি দেখি নাই কোনসময় বেশি একটা…হে হে)! যেখানে YK তে কিছুদূর গিয়ে আপনার বোরিং লাগতে পারে।[vi] তবে একজনের বুঝতে হবে যে ডক্টরাল থিসিস প্রাকৃতিকভাবেই পড়তে মজা হওয়ার কথা না। CSR বই আকারে পাবলিশড; তাও ব্রিল থেকে — বই পাবলিশ করার সময় অনেক কিছু ঠিক করা হয় যেন সাধারণ পাঠকের পড়তে সুবিধা হয়। যেখানে ডক্টরাল থিসিসের সময় এমন কিছুই করা হয় না। বইয়ে এক্সট্রা আরও অনেক কিছু থাকে যা থিসিসে থাকবে না। তাই CSR এ আপনি অ্যাপেন্ডিক্স, গ্লসারি, ইন্ডেক্স এসব পাবেন কিন্তু YK এ নাই।

মূল লেখার ক্ষেত্রে YK এর পৃষ্ঠাসংখ্যা আসলে CSR থেকে বেশি, CSR এ গ্লসারি, অ্যাপেন্ডিক্স ইন্ডেক্স এর জন্য একশ পৃষ্ঠার মত বেড়ে গেছে। CSR এ অবশ্য লেখা ঘন যেখানে YK ফাকা ফাকা।

যে বছর ইয়াসির ক্বাদি ডক্টরেট করেন, ঠিক সেই বছরই কার্ল শারিফ তোবগুইও ডক্টরেট করেন। ২০১৩ সালে করা উনার ডক্টরাল থিসিসের[vii] সাথে ২০২০ সালের বইয়ের পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। মূল বই থেকে লাইন গ্যাপ খানিকটা বেশি। এক্সট্রা কিছু নেই। YK বই আকারে পাবলিশ হলে সেটাও ঝাকানাকা হয়ে যেত।

নাম দেখতে একইরকম রকম হলেও দুইটা আলাদা স্টাডি। যদি CSR এর থিসিস-নাম দেখি — Reason, Revelation & the Reconstitution of Rationality — তিনি ইবন তাইমিয়্যার যৌক্তিকতার পুনর্গঠনে মূলত ফোকাস করেছেন। YK এ প্রথমেই reconciliation শব্দ টা আছে। অর্থাৎ এটা যুক্তি আর ওয়াহয়ি এর মাঝে সামঞ্জস্যবিধান এর কাজ করে। অবশ্য সেটাই (ইবন তাইমিয়্যার) বইয়ের মূল প্রতিপাদ্য, তবে সাথে দিয়ে ইবন তাইমিয়্যার চিন্তাধারার আরো অনেক দিক তার এই কাজে প্রকাশ পেয়েছে, যা দেখানো YK এর কাজ না। আর এটা কেবলমাত্র এই দিকটা বিশ্লেষণ করে — analytical study। ব্যাখ্যা করাও YK এর উদ্দেশ্য না।

CSR এর একটা জিনিস কম আছে, যা তিনি বইয়ের শুরুতেই ক্লিয়ার করেছেন।[viii] চার হাজার পৃষ্ঠার কঠিন একটা বই নিয়ে গবেষণায় অনেক শ্রম চলে গিয়েছে, ইবন তাইমিয়্যার অন্যান্য কাজ দেখা সম্ভব হয় নি। কার্ল শারিফ তোবগুই স্পষ্টত বলেছেন যে এই বইয়ে যা বলা হবে, তা ইবন তাইমিয়্যার সামগ্রিক ভিউ না। শুধুমাত্র দার আল-তা’আরুদ এ যা আছে তা। কিন্তু YK এ আপনি এই জিনিসটা বেশি পাচ্ছেন যে যা বলা হয়েছে তা ইবন তাইমিয়্যার সামগ্রিক ভিউ। কার্ল শারিফ তোবগুই পুরোপুরি একজন অ্যাকাডেমিক এবং যখন কিছু পড়েন রিসার্চ পেপার বা বই লেখার উদ্দেশ্যে পড়েন। কিন্তু যেহেতু ইয়াসির ক্বাদি ‘আলিম, এবং মদিনায় ১০ বছর স্টাডি করেছেন — পড়ার সময় দা’ওয়ার কথা মাথায় রেখে পড়েন এবং ইবন তাইমিয়্যার অনেক কাজই তার পড়া আছে। সুতরাং YK তে যা পাবেন, ইবন তাইমিয়্যা তাই বিশ্বাস করতেন শতভাগ নিশ্চিত। CSR এও নিশ্চিত — সেরা একটা রিসার্চ। কিন্তু কিছুটা গ্যাপ থাকে — নিজেই যেমন স্বিকার করেছেন। তবে তিনি খুব সম্ভবত ২০১৯ সাল পর্যন্ত ইবন তাইমিয়্যার ফিলসফি সংক্রান্ত যত মডার্ন রিসার্চ হয়েছে সবই পড়েছেন। যার কারণে আশা করা যায় যে গ্যাপ টা পূরণ হয়ে যায়।

সাইডের কথাবার্তা শেষে এবার মূল বইয়ের গঠনে যাই। দু ক্ষেত্রেই প্রথমে ইবন তাইমিয়্যার আগে মুসলিম বিশ্বে যুক্তি ও ওয়াহয়ি (Reason and Revelation) নিয়ে কি পরিমাণ কাজ হয়েছিল, কতটুকু বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল আর পরিবেশ কিরকম ছিল তা বোঝানো হয়েছে। YQ তে আশ’আরি ধর্মতত্ত্বের ডেভেলপমেন্ট ও ক্ষমতায় রাইজ নিয়ে মোটামোটি ভালো একটা বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। CSR এ জেনারালি বিভিন্ন টাইপের মানুষদের চিন্তাধারার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।

এরপর ইবন তাইমিয়্যার জীবন। YK তে কিছু নাই, একেবারেই সংক্ষেপ। CSR এ একটা ভালো বর্ণনা আছে এ ক্ষেত্রে। সেটা অবশ্য হেনরি লাউস্ট এর লেখাসমূহের সামারি।[ix]

YK এরপর ধরে ধরে সংক্ষেপে ৪৪ টা পয়েন্ট বিবৃত করা হয়েছে। তারপর আবার ৬ টা মোটিফে বিভক্ত করে একটা থেমাটিক ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়েছে। CSR এর ক্ষেত্রে আমরা ৩য় চ্যাপ্টার এ পদার্পণ করি — যেখান থেকে ইবন তাইমিয়্যার দর্শন শুরু হয়। খুবই চমৎকার এক স্টাইলে CSR এ জিনিসটা বর্ণনা করা হয়েছে।

এরপর ইয়াসির ক্বাদি ‘আক্‌ল (যুক্তি প্রসূত জ্ঞান) এর ব্যাপারে ইবন তাইমিয়্যা পূর্ব স্কলাররা কি বলেছেন তা তুলে ধরেছেন তারপর ইবন তাইমিয়্যার চিন্তাধারা তুলে ধরেছেন। ইবন তাইমিয়্যার উপর কার কার প্রভাব পড়েছে সেটা দেখিয়েছেন। তারপর নাক্‌ল (ওয়াহয়ি কানেক্টেড সকল জ্ঞান) ব্যাপারে ইবন তাইমিয়্যার চিন্তাধারা দেখিয়েছেন।চতুর্থ চ্যাপ্টারে গিয়ে CSR এ ইবন তাইমিয়্যার পরিভাষা ও (ধর্মতত্ত্বে) ভাষার পুনর্গঠন নিয়ে একটা ভালো বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।

YK এর তৃতীয় চ্যাপ্টার শেষ চ্যাপ্টার। এখানে যুক্তি ও ওয়াহয়ি এর রিকন্সিলিয়েশন নিয়ে ইবন তাইমিয়্যার ভাবধারার সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ইবন তাইমিয়্যা, ফাখর আল-দ্বীন আল-রা্যী বিপরীতে কি অল্টারনেটিভ দিয়েছেন সেটা এই চ্যাপ্টারের মূলবিষয়। ইবন তাইমিয়্যার পুরো অল্টারনেটিভই আসে মানব ফিতরাহর ধারণা থেকে। যার জন্য ইয়াসির ক্বাদি এখানে ইবন তাইমিয়্যা পূর্ব স্কলাররা ফিতরার ব্যাপারে কি বলেছেন তা তুলে ধরার পর ইবন তাইমিয়্যার থিওরি ব্যাখ্যা করেছেন। আগের মত এবারো কার কার প্রভাব ইবন তাইমিয়্যার উপর পড়েছে তা তিনি দেখিয়েছেন। ইবন তাইমিয়্যার যত লেখায় ফিতরা নিয়ে যত কিছু সব ইয়াসির ক্বাদি তুলে ধরেছেন। এই কাজের প্রশংসা না করে থাকা যায় না। CSR এ ফিতরা নিয়ে জানার জন্য YK এর কথা আলাদাভাবে উল্লেখিত হয়েছে।[x]

শেষে মিসাক (adamic covenant) এর ব্যাপারে বিভিন্ন স্কলারের বিবৃত করার পর পূর্ব প্যাটার্নে ইবন তাইমিয়্যার মতের সংক্ষিপ্ত একটা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। সব শেষে ইব্রাহিম আলাইহিসসালাম এর সত্য খোজ নিয়ে আল-রাযী ও ইবন তাইমিয়্যার পজিশন ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ইবন তাইমিয়্যার সমালোচনার পয়েন্ট গুলো তুলে ধরা হয়েছে। CSR এ আমরা ভাষার কাহিনীর পর ইবন তাইমিয়্যার তা’উইল এ পদার্পণ করি। এরপর ইবন তাইমিয়্যার ইউনিভার্সাল এর দর্শনের বিস্তারিত বর্ণনা। শেষে কিয়াস আল-গ্বাইব ‘আলা আল-শাহিদ মানে যা আমরা দেখি তার উপর ভিত্তি করে যা আমরা দেখি না তার ব্যাপারে জানতে যাওয়া নিয়ে ইবন তাইমিয়্যার চিন্তাধারা ব্যাক্ত করা হয়েছে। ভিতরে অবশ্য তাওয়াতুর জ্ঞান নিয়েও কিছু কথা লেখা হয়েছে।

CSR দার আল-তা’আরুদ অনুযায়ী ইবন তাইমিয়্যার দর্শন চমৎকার ভাবে তুলে ধরেছেন। আপনি যদি দার্শনিক ব্যাক্তিত্ব হন, নিশ্চিন্তে CSR নিয়ে পড়া শুরু করে দিন। তবে উচিত হবে দুইটাই পড়া। দুটো তে (বিস্তৃত অর্থে) যেসব আছে, এক লাইনে বললে –

YK: আশ’আরিদের ক্ষমতায় উত্থান, ৪৪টা পয়েন্ট, থেমাটিক ওভারভিউ, আকল আর নাকল, ইবন তাইমিয়্যার ফিতরার থিওরি (সেরা অংশ), মিসাক, ইবরাহিম এর সত্যের খোজ নিয়ে বিতর্ক।

CSR: ইবন তাইমিয়্যা পূর্ব মানুষরা যুক্তি ও ওয়াহয়ি এর সামঞ্জস্যবিধানে কি কাজ করেছেন, ইবন তাইমিয়্যার জীবন ও কাজ, যুক্তি ও ওয়াহয়ি এর সামঞ্জস্যে ইবন তাইমিয়্যা কে নিয়ে বেসিক আলোচনা, ভাষার পুনর্গঠন, ইবন তাইমিয়্যার তা’উইল, ইউনিভার্সাল এর দর্শন, কিয়াস আল-গ্বাইব ‘আলা আল-শাহিদ।

কেনঃ ইবন তাইমিয়্যার বইয়ের বিষয়বস্তু

(অত্যন্ত সংক্ষেপে এখানে বলার কারণে পাঠক কিছু জিনিস নাও বুঝতে পারেন। কমেন্ট করলে আমি বুঝবো আমার লেখার স্টাইলে দুর্বলতা কোন জায়গায়, তবে আপনাকে সাহায্য করার জন্য সম্ভবত বই পড়ার উপদেশই দিবো। পয়েন্টে পয়েন্টে পৃষ্ঠা নাম্বার দিয়ে রেখেছি, আমি আশা করবো যে পাঠক যে জিনিসটা বুঝবেন না সেটার জন্য পৃষ্ঠা সংখ্যার অনুসরণ করে কনসেপ্ট টা বুঝে নিবেন)

যে পয়েন্ট এর সমালোচনার উদ্দেশ্যে দার আল-তা’আরুদ লেখা, সেটা কানুন আল-কুল্লি (Universal Rule — CSR, YK তে অনুবাদ না করে আরবিটাই ব্যাবহার করা হয়েছে) বা কানুন আল-তা’উইল নামে পরিচিত।

ফাখর আল-দ্বীন রাযীর কানুন হচ্ছেঃ যখন যুক্তি আর ওয়াহয়ি এর সংঘাত হবে, তখন যুক্তিকে প্রাধান্য দিয়ে কুরআনের আয়াত কে মেটাফরিকালি ব্যাখ্যা করতে হবে।

আরেকটু ভালো ভাষায় বললে, কুরআনকে এমন ভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে যেন তা (কল্পিত) যুক্তির সাথে মিলে।

শক খেয়ে থাকলে খুব স্বাভাবিক।

আমি সবার প্রথমে জিনিসটা দেখেছিলাম আমিনা ওয়াদুদ এর মধ্যে, যখন Misquoting Muhammad গ্রন্থে ড. জোনাথান ব্রাউন তার সমালোচনা করেছিলেন। আমিনা ওয়াদুদের কথা ছিল, কুরআনের কোন কিছু যদি ‘মডার্নিটি’র বিপরীতে যায়, তাইলে যেভাবে হোক, কুরআনের সেই অংশ কে অন্যরকম ভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে।

তখন তো একেবারে মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল! মুসলিম এত নিচে কিভাবে নামে? পরে দেখি আসলে, আ…আমাদের ইন্টেলেকচুয়াল হিস্ট্রি তে জিনিসটা ভালোভাবেই আছে। এমনকি ইবন তাইমিয়্যা সরাসরি এক জায়গায় বলেছেন যে এই তা’উইল এর কারণে ইসলামের এতগুলো সেক্ট তৈরি হয়েছে। প্রতিটা সেক্ট একই কাজ করে, যতগুলো আছে। নিজের পূর্ব বিশ্বাস অনুযায়ী কুরআন ব্যাখ্যা করে। আগে একটা মাইন্ডসেট তৈরি করে নেয়, সে অনুযায়ী কুরআনে আয়াত খুজে। কিছু বিপরীত হলে — let’s go metaphorical।[xi] চরম কথা। সেই ৮ম-৯ম শতক থেকে এই ২১শ শতক পর্যন্ত এটা হয়ে আসছে।

পাশেই রোমান সাম্রাজ্য ছিল, পার্সিয়ান সাম্রাজ্য ছিল, কিন্তু আল্লাহ সে উচ্চশিক্ষিত জাতিগুলোতে কুরআন না পাঠিয়ে পাঠিয়েছেন আরবদের মত উম্মিদের কাছে। যেন তারা ফাকা মস্তিষ্ক নিয়ে কুরআন পড়তে যায়। যেন নিজের বিশ্বাস কুরআনের উপর না চাপিয়ে কুরআন থেকে বিশ্বাস গঠন করে। কিন্তু পরে মানুষরা অন্যান্য জায়গা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কুরআন পড়তে বসে সব পেঁচিয়ে ফেলে।[xii]

আমিনা ওয়াদুদের দাবী তো পুরাই দেউলিয়া — কিন্তু ফাখর আল-দ্বীন রাযী শুধু শুধু কথাটা বলেননি। তার কাছে কারণ ছিলঃ

আমরা কুরআন বুঝি আক্‌ল দিয়ে। কুরআন যে আল্লাহর বাণী আর মুহাম্মাদ ﷺ যে আল্লাহর রাসুল, সেটা আমরা আক্‌ল দিয়েই বুঝেছি। সুতরাং ওয়াহয়ি এর সাথে যুক্তির সংঘাত হলে ওয়াহয়ি কে কিভাবে প্রাধান্য দেওয়া যেতে পারে? অবশ্যই আক্‌ল কে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।

সামনে আগানোর আগে এটা ক্লিয়ার করা উচিত যে এটা আল-রাযী একা বলেননি। এটা স্ট্যান্ডার্ড আশ’আরি পজিশন ছিল। এর আগে অনেকে — বিশেষ করে আবু হামিদ আল-গাযালী এমন বলেছিলেন, যার থেকে মূলত কানুন আসে আরকি। তো, ফাখর আল-দ্বীন রাযীই কেন? তিনি ইবন তাইমিয়্যার সময়ের সবচেয়ে কাছে ছিলেন। তিনি তখন সবচেয়ে সেরা আশ’আরি স্কলার হিসেবে খ্যাত ছিলেন। তার লেখার মধ্যে সবকিছু বিস্তৃত ও পারফেক্টভাবে বর্ণিত ছিল ইবন তাইমিয়্যার জন্য। সবচেয়ে বড় কথা — তিনি একজন যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন।[xiii] So the game is on।

প্রথম পয়েন্টে ইবন তাইমিয়্যা নরম ছিলেন। বলেছেন যে হ্যা, নির্দিষ্ট শর্ত সাপেক্ষে আল-রাযীর কথা মানা যেতে পারে। যদি এমন হয় যে কুরআনের আয়াতের অর্থ বোঝা যাচ্ছে না, আর যে যুক্তি প্রয়োগ করা হচ্ছে সেটা সন্দেহাতীত — কেবল মাত্র তখনই এটা করা যেতে পারে।

তবে ১৬-১৭ পয়েন্টে যেতে যেতে আল-রাযীকে একদম ধুয়ে দিয়েছেন। যুক্তিকে ওয়াহয়ি এর উপর স্থান দেওয়া সিরিয়াস ভুল। আশ’আরিদের অবস্থানের মূল কারণ ছিল কুরআনকে অযৌক্তিকতার অভিযোগ থেকে মুক্ত করা।[xiv] কিন্তু আসলে, যুক্তিকে ওয়াহয়ি এর উপর স্থান দিলে উল্টোটা হয়। বরং এ কাজের মাধ্যমে যুক্তিকেই আন্ডারমাইন করা হয়।

তিনি স্বীকার করেছেন যে হ্যা, কুরআন কে আমরা যুক্তি দিয়েই বুঝি, আক্‌ল দিয়েই সব কাজ হয়। কিন্তু, যুক্তিকে প্রেফারেন্স দিলে অনেক ধরণের সমস্যা সৃষ্টি হয়।[xv] যদি মানুষ না থাকতো, কোন কিছু না থাকতো, তবু আল্লাহর বাণী থাকতো। সুতরাং সেটাকে অবশ্যই অবশ্যই সত্য ধরে নিতে হবে। ‘হায় হায় এটা তো ভুল! একে রহিত করতে হবে, অন্যভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে’ খুবই বাজে মেন্টালিটি। আর, আমরা যুক্তি দিয়ে এটা বুঝে গিয়েছি যে কুরআন আল্লাহর বাণী, মুহাম্মাদ ﷺ কে আল্লাহই পাঠিয়েছেন। সুতরাং এরপর আমরা আর এটাকে প্রশ্ন করতে পারি না। যুক্তি দিয়ে এটা ইতিমধ্যে পরীক্ষিত, সুতরাং খাটি যুক্তির (আক্‌ল সারিহ্‌) সাথে ওয়াহয়ি এর সংঘাত সম্ভবই না। এই জিনিসটা বোঝানোর জন্য ইবন তাইমিয়্যা সেরা একটা উদাহরণ দিয়েছেন যা CSR এ চমৎকার ভাবে তুলে ধরা হয়েছে।[xvi] তবে বড় হয়ে যাবে দেখে দিচ্ছি না। পড়ে নিবেন বই থেকে। এখানে একটা জিনিস মজা লেগেছিল সেটা বলছি। ইবন তাইমিয়্যা বলেন, আল-রাযী ও অন্যান্য আশ’আরিরা যে দাবী করছেন, তা হল এরকমঃ

ইনি হলেন আল্লাহর নবি। ইনি যা বলেন সব সত্য বলেন। কিন্তু তুমি এনার কোন কথা শুনতে পারবা না!

মানে কথা সরাসরি না নিয়ে তারা ‘যুক্তি’র অজুহাত দিয়ে যে মেটাফরিকাল ব্যাখ্যা করে, সেটা সমালোচনা করা হচ্ছে। ইবন তাইমিয়্যা যেটা বলতে চান, যুক্তির মধ্যে সমস্যা না, সমস্যা তারা ‘যুক্তি’ বলতে যেটাকে বোঝায় সেটার মধ্যে।[xvii] ইবন তাইমিয়্যার বিশ্বাস হচ্ছে reason is intrinsic to revelation। তিনি বলেনঃ Any state that is achieved in the absence of intellect is deficient, and any statements that contradict the intellect are false।[xviii] আর আসলে, ইবন তাইমিয়্যা বলেন, এখানে যুক্তি আর ওয়াহয়ি এর সংঘাত নিয়ে কথাই হচ্ছে না। মূলত কথা হচ্ছে নিশ্চিত ও সম্ভাব্য এর মাঝে। কোনটা অধিক গ্রহণযোগ্য কোনটা কম গ্রহণযোগ্য তার মাঝে। যেটা নিশ্চিত বা সন্দেহাতীত সেটাই মূল ধরতে হবে।[xix] আর যুক্তিকে কখনও যা আল্লাহ প্রদত্ত (শার’ই) তার বিপরীতে দাঁড় করানো যাবে না; এটা একেবারেই ভুল কেননা শার’ইর বিপরীত বিদ’ই।[xx]

আর ৩৭-৩৮ নাম্বার পয়েন্টে গিয়ে তো একদম ছিড়ে-বিড়ে ফেলে দিয়েছেন আল-রাযী কে। কিন্তু ফিতনার আশংকায় সে পর্যন্ত যাচ্ছি না। যারা বই পড়বেন তারা জানুন সেটাই ভালো।

একদম শেষে তিনি বলেছেন, নাকলি বা আকলি, যে প্রমাণই হোক না কেন, যদি তাকে ভ্যালিড প্রমাণ দেওয়া হয় তাহলে তিনি তার বিরুদ্ধবাদীদের কথা মেনে নিবেন।[xxi]

কনটেক্সচুয়াল তা’উইল

বেশিরভাগ স্কলার — মুসলিম ও নন-মুসলিম — ইবন তাইমিয়্যা কে লিটারালিস্ট হিসেবে দেখিয়ে এসেছেন। কিন্তু মডার্ন রিসার্চ এ অবশেষে দেখা যাচ্ছে যে এটা ঠিক না। ইবন তাইমিয়্যা কে বরং ‘টেক্সচুয়ালিস্ট’ বলা উচিত। ইবন তাইমিয়্যার তা’উইল হচ্ছে কনটেক্সচুয়াল। মানে, তিনি বলেন যে টেক্সট বুঝতে হলে লেখক যা বোঝাতে চাচ্ছেন, লেখকের লাইফ স্টাডির মাধ্যমে বা অন্যান্য বই দেখার মাধ্যমে বা একই বইয়ের বিভিন্ন অংশ দেখার মাধ্যমে তার ‘ইন্টেন্ডেড মিনিং’ বোঝার চেষ্টা করা।[xxii] হাদিসের ক্ষেত্রে বক্তা মানে রাসুল ﷺ কি বোঝাতে চাচ্ছেন তা সে সময়ের পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপট দেখার মাধ্যমে বুঝতে হবে। কুরআনের ক্ষেত্রে কুরআনের বিভিন্ন অংশ দেখে বুঝতে হবে আল্লাহ কি বোঝাতে চাচ্ছেন (এখানে আরও জিনিস আছে)।[xxiii] আক্‌ল এর নাম দিয়ে যেভাবে খুশি সেভাবে ইন্টারপ্রেট করা যাবে না। কার্ল শারিফ তোবগুই এখানে সেরা একটা লাইন লেখেছেনঃ What can mean everything, doesn’t mean anything.

পরিভাষা

উপরে তা’উইল (মেটাফরিকাল ইন্টারপ্রেটেশন, এই কনটেক্সটে) নিয়ে ইবন তাইমিয়্যার মত দেখানো হয়েছে যে এর কারণে ইসলামের এতগুলো সেক্ট তৈরি হয়েছে। ইবন তাইমিয়্যা সেক্ট সৃষ্টির দ্বিতীয় কারণ বলেছেন পরিভাষার অপপ্রয়োগ। একেকজন একই শব্দের ভিন্ন ডেফিনিশান ইউজ করে বলে এত গুলো সেক্ট তৈরি হয়েছে। মানুষ ইচ্ছা করে অস্পষ্ট ও কঠিন পরিভাষা ব্যবহার করে যেন সাধারণ কেউ সেটা না বুঝে, আর তার উপর চড়াও হয়ে কেউ নিজের মতাদর্শ খাইয়ে দিতে পারে। যে জিনিসটা বর্তমান পর্যন্ত হয়ে আসছে, আবারো।[xxiv]

মুসলিমের আর্গ্যুমেন্টেশন

ইবন তাইমিয়্যা বলেন — ইসলামে মিথ্যা কথা বলা যেরকম হারাম, ভুল যুক্তি দেওয়াও সেরকম হারাম[xxv]। ফ্যালাশাস আর্গ্যুমেন্ট জঘন্য মিথ্যাচারের মতন। এটা প্রমাণ করার জন্য তিনি একাধিক আয়াত দিয়েছেন। যুক্তি উপস্থাপনের সময় একজনের অবশ্যই তা পরীক্ষা করে দিতে হবে। মাথায় একটা জিনিস আসলো আর বলে দিলাম — ইসলাম সেটা পারমিট করে না। আর্গ্যুমেন্ট সাউন্ড কিনা সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য একজনের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। যে একটা আর্গ্যুমেন্ট নিজে থেকে ঠিকমত বুঝে না, তার উপরো সেটা ব্যবহার করা হারাম; যদিও অন্য একজন সেটা প্রমাণ করে থাকে।[xxvi]

ফিতরার থিওরি

ইবন তাইমিয়্যার আগে ফিতরা (Original Normative Disposition — CSR) নিয়ে কথা হলেও, কেউ ফিতরা নিয়ে এমন প্রোফাউন্ড থিওরি দেয় নি। এটা আসলেই সেরা, আর, সবার পড়া উচিত মাস্ট আমি বলবো। YK তে এ নিয়ে যে রিসার্চ দেওয়া হয়েছে, সেটাই আজ পর্যন্ত করা সবচেয়ে সেরা রিসার্চ।[xxvii]

কালামের ভিত্তি হচ্ছে — শিশু আল্লাহর জ্ঞান নিয়ে জন্মায় না (i.e. ফিতরা থেকে তেমন কিছুই পাওয়া যায় না)। এজন্য একটা যৌক্তিক মস্তিষ্কের প্রথম কাজ হচ্ছে আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণ করা। আবু হামিদ আল-গাযালী আর আল-রাযী দুইজনই ফিতরার ব্যাপারটাকে প্রায় এড়িয়ে গিয়েছেন।[xxviii]

আশ’আরিরা যে ফিতরাকে একেবারে কোন গুরুত্বই দেননি, ইবন তাইমিয়্যা এই বিষয়টার তুমুল সমালোচনা করেছেন। ফাখর আল-দ্বীন রাযী ঈশ্বরের অস্তিত্বের জন্য ৫ টা আর্গ্যুমেন্ট দিয়েছিলেন। ৪টার ইবন তাইমিয়্যা সমালোচনা করেন। ৫ নাম্বার টার সাথে একমত হন। তবে তার কথা হচ্ছে এতসবের প্রয়োজনই ছিল না। ফিতরা ব্যাবহার করে অনেক সহজেই সমস্যাটা সমাধান করা যায়।[xxix] শুধুশুধু এত ঘাম ঝরিয়েছেন আল-রাযী।

ফিতরা, ইবন তাইমিয়্যার মতে হল ‘General Islam’ (YK)। জেনারাল ইসলাম কি আবার? ইবন তাইমিয়্যা বলেনঃ ঈশ্বরের অস্ত্বিত্বের ধারণা ও ভালোত্বের দিকে একজন মানুষের টান। এটাই। তিনি ক্লিয়ার করে বলেন, “ফিতরা হচ্ছে আল্লাহ কে জানা ও (তার অস্তিত্ত্ব কে) মানা, দ্বীন আল-ইসলাম না”।[xxx]

দিনশেষে, সত্যে পৌঁছানোর জন্য ইবন তাইমিয়্যার মডেল হচ্ছে ফিতরা, ওয়াহয়ি আর যুক্তি এর ট্রায়াড।[xxxi] ফিতরা সবচেয়ে শক্ত, তারপর ওয়াহয়ি, তারপর আক্‌ল। ওয়াহয়ি কে পরে রাখার কারণ হল, ইবন তাইমিয়্যা বলেন, ফিতরা ভুল থাকলে কুরআন পড়ে বেশি একটা লাভ নেই। উল্টাপাল্টা ব্যাখ্যা করে আরও ভুল পথে চলে যাবে (কুরআন ৩:৭)। আর আক্‌ল এর সঠিক প্রয়োগে সেটাও অনেক বেশি শক্তিশালি আর কাজের হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু, সঠিকভাবে ওয়াহয়ি পাঠ ও যুক্তির সঠিক প্রয়োগ আসে ফিতরা থেকে। এজন্য এটাই সবচেয়ে বেশি ইম্পরট্যান্ট। ফিতরা যেকোন ধরণের জ্ঞানের গভিরতম মূল, যেকোন জ্ঞান থেকে বেশি সলিড আর অন্য সকল ফাউন্ডেশনের ফাউন্ডেশন। মৌলিকভাবে ফিতরা হল তিনটা জিনিসঃ আল্লাহকে জানার জ্ঞান (মা’রিফা), আল্লাহর ভালোবাসার অনুভূতি (মাহাব্বা) আর এটা বুঝতে পারা যে আল্লাহ একা অন্য যেকোন কিছু থেকে অধিক ভালোবাসার যোগ্য, যা তাওহিদ এর মূল।[xxxii] ফিতরা পূর্ণতা প্রাপ্ত হয় নবুয়তের শিক্ষার অনুসরণ, ওয়াহয়িকে গ্রহণ, তাকওয়া এবং যৌক্তিক চিন্তাকে পরিশীলিত করার মাধ্যমে। ফিতরা কলুষিত হয় সন্দেহের দ্বারা, (কু)প্রবৃত্তির অনুসরণের মাধ্যমে এবং একটা নষ্ট পরিবেশের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে।[xxxiii]

তো, ফিতরা দিয়ে পারফেক্ট মুসলিম হয়ে উঠবেন কিভাবে? ইবন তাইমিয়্যা ৭ টা পয়েন্ট দিয়েছেন। যাকে তিনি বলেছেন সাতটি মারাত্মক গুনাহ। ১) এমন (অপরীক্ষিত) জিনিস বিশ্বাস করে নেওয়া যা একজন নিজের পরিবার, পরিবেশ বা সংস্কৃতি থেকে পায় (ই’তিক্বাদ মাওরুসা)। ২) প্রবৃত্তির অনুসরণ, পূর্ববিশ্বাস জনিত বায়াস, একরোখা ভাবে নিজের ব্যাক্তিগত মতামতে আটকে থাকা যখন বিপরীতে শক্ত প্রমাণ থাকে (হাওয়া)। ৩) ধারণা প্রসূত কিছু বিশ্বাস করা (যান্ন্‌)[xxxiv]। ৪) কিছু আপাত ভাবে শক্ত কিন্তু বাস্তবে দুর্বল টাইপের প্রশ্ন (বা অন্য কিছু) দেখে উত্তর খুঁজতে বা যথেষ্ট চিন্তাভাবনা না করেই একটা বিষয়ে নিজেকে সন্দেহে ফেলা (শুবুহাত)। ৫) কোন উদ্দেশ্য বা ব্যাক্তিগত (বায়াস্‌ড) ইন্টারেস্ট রেখে জানতে যাওয়া (conflict of interest) (গারাদ)। ৬) (চিন্তাহীন) অভ্যাস (‘আদা) এর অন্ধঅনুসরণ। ৭) অন্ধঅনুসরণ — না বুঝে, না জেনে অনুসরণ (তাকলিদ)।

যদি কারো নিজের ফিতরা কে রক্ষা করতে হয়, তাহলে এই ৭ টা থেকে নিজেকে সারাজীবনে রক্ষা করতে থাকতে হবে। যার মধ্যে সাতটা থাকবে, তার ফিতরা সে সময়ের জন্য মৃত। আর ইবন তাইমিয়্যা এ ব্যাপারে এক্সপ্লিসিটলি ক্লিয়ার যে, ফিতরা ঠিক না থাকলে একজন মানুষের কুরআন পড়েও লাভ নেই, যুক্তির প্রয়োগ দিয়েও কিছু হবে না। উপরোক্ত সাতটা ঠিক করার সৎ নিয়্যাহ নিয়ে কুরআন-হাদিস পড়তে হবে। ৭ টা ঠিক করার পর একজন কুরআন থেকে নিতে পারবে এবং আক্‌ল এর আসল প্রয়োগ করতে পারবে।[xxxv]

ফিতরা দিয়ে ইবন তাইমিয়্যা বিশাল সমস্যার সমাধান দিয়েছেন and this is totally brilliant! এটা আগের সব স্কলারের মধ্যে গ্যাপ ছিল। আল-রাযী এটাই পারেন নাই। তারা যে জায়গায় যুক্তিকে বসাচ্ছিলেন, সে জায়গায় ফিতরা কে বসিয়ে একদম পুরো খেলাই ঘুরিয়ে দিয়েছেন ইবন তাইমিয়্যা!

— — — — — — — -

তো, এই পর্যন্ত পড়ে বা বই পড়ার পর যদি কারো মনে হয় যে ফাখর আল-দীন আল-রাযী খুব খারাপ একটা মানুষ ছিলেন বা ইসলাম বিরুদ্ধবাদী ছিলেনে তাইলে বলে রাখছি — তিনি ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে সেরা স্কলারদের একজন। অনেকে উনাকে ষষ্ঠ মুজাদ্দিদ পর্যন্ত ধরেছেন[xxxvi]। ইবন তাইমিয়্যা নিজে উনার স্টার স্টুডেন্ট ইবন আল-কায়্যিম কে আল-রাযীর লেখা বই পড়িয়েছেন।[xxxvii] ৩২ খণ্ডে লেখা আল-রাযীর তাফসির মাফাতিহ আল-গাইব এর উপর ইবন তাইমিয়্যার সমালোচনা “এতে সবই আছে, তাফসির ছাড়া” কে তাজ আল-দ্বীন সুবকী ভূয়সী প্রশংসা বানিয়ে বলেছেন “এতে তাফসির সহ সব আছে”।[xxxviii]

আর ইবন তাইমিয়্যারও কিছু গ্যাপ আছে, কিছু সমস্যা আছে। কিন্তু ‘আলিমদের ভুল ধরানোর কোন ইচ্ছা আমার নাই। এখানে বইই ফাখর আল-দ্বীন আর-রাযীর বিরুদ্ধে তো সেক্ষেত্রে কিছু করার ছিল না।

দুই বইয়ের রেফারেন্স পর্যালোচনা

গ্রন্থপঞ্জি বইয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। রেফারেন্স আর গ্রন্থপঞ্জী তে চোখ বুলানোর মাধ্যমেই একটা বইয়ের কোয়ালিটি সম্পর্কে আর লেখক কোন টাইপের — মানে পুরানা আমলের মানুষ, ওরিয়েন্টালিস্ট, পোস্ট-ওরিয়েন্টালিস্ট গরিব স্কলার না ক্রিটিকাল অ্যানালাইসিস বেসড তুখোড় স্কলার সেটা সম্বন্ধে অনেক ভালো একটা ধারণা পাওয়া যায়। একটা বই কতটা নির্ভরযোগ্য সেটাও বোঝা যায়। আর রেফারেন্স মাইনিং এর মাধ্যমে অনেক সেরা সেরা কাজ সম্বন্ধে জানা যায়। এর পরে কোন বই পড়বো সেটা নিশ্চিত হয়ে নিই।

মূল আলোচনায় আসি। উপরে যেমন বলেছি, YK তে বেশিরভাগ রেফারেন্সই ক্লাসিকাল টেক্সট যেখানে CSR এ সব মডার্ন রিসার্চ। ক্লাসিকাল টেক্সট কার্ল শারিফ তোবগুই খুব কমই ব্যবহার করেছেন।

ইতিহাসের ক্ষেত্রে YK তে ব্যবহার করা স্কলার হলেন উইলিয়াম মন্টগমারি ওয়াট, রিচার্ড বুলিয়েট, ইগনায গোল্ডযিহার আর টিম নেগেল। তাছাড়া ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে কথা বলার সময় ওয়ায়েল হাল্লাক্ব কে ব্যবহার করা হয়েছে।ওভামির আনজুম থেকে অনেক কিছু নেওয়া হয়েছে এখানে। এছাড়া তেমন কোন মডার্ন রিসার্চারকে বারবার সাইট করা হয়নি। এখানে অত্যন্ত ইন্টারেস্টিং একটা জিনিস আছে যে, ইয়াসির ক্বাদি যেসব রেফারেন্স ব্যবহার করেছেন, সেসবে করা ভুল গুলোও ধরিয়ে দিয়েছেন। মানে রেফারেন্সগুলোর একটা অ্যাসেসমেন্ট পাচ্ছি আমরা বইটিতে বোনাস হিসেবে।

CSR এ ইতিহাসের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা স্কলাররা হলেন উইলিয়াম মন্টগমারি ওয়াট, জোসেফ ভ্যান এস্‌, মাজিদ ফাখরি ও টিম নেগেল। ইউসুফ র‍্যাপোপোর্ট এর সম্পাদিত ibn Taymiyya and His Times গ্রন্থের আর্টিকেলগুলোর অনেকবার ব্যবহার করেছেন তিনি। ভাষার ক্ষেত্রে ইয়ুনিস খান ও রবার্ট গ্লিভস এর বিস্তৃত ব্যাবহার রয়েছে। যদিও অতিরিক্ত না, তবে দুই বইয়ে রেফারেন্সে ফ্র্যাঙ্ক গ্রিফেলের নাম কয়েকবার চোখে পড়েছে। CSR এ দেওয়া বিবলিওগ্রাফি ৩১ পৃষ্ঠার খুবই কম্প্রেহেন্সিভ একটা বিবলিওগ্রাফি। তলিবুল ইলমদের[xxxix] না পড়লে বিশাল মিস!

CSR এক্সট্রা যেটা করেছেন সেটা হল, একটা কনসেপ্ট নিয়ে কথা বলার সময়ে দার আল-তা’আরুদ এ যত জায়গায় জিনিসটা নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে তার প্রতিটি উল্লেখ করেছেন। প্রতিটা ইম্পরট্যান্ট লাইনের জন্য নোটে অ্যারাবিক দিয়েছেন (ইংরেজি ট্র্যান্সলিটারেশন)।

Notes and Citations

[i] একজন কনভার্ট। McGill University থেকে ইসলামিক স্টাডিজ এর উপর পিএচডি সম্পন্ন করেছেন।বর্তমানে ব্র্যান্ডিস ইউনিভার্সিটিতে অ্যারাবিকের প্রফেসর। তিনি বিখ্যাত এক্টিভিস্ট ড্যানিয়েল হাকিকাতজুর বন্ধু।

[ii] University of Houston থেকে কেমিকাল সায়েন্সে ব্যাচেলর্স করার পর মদিনা ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখা করতে চলে যান ১০ বছরের জন্য। অ্যামেরিকায় ফিরে এসে Yale University তে পিএচডি সম্পন্ন করেন। বর্তমানে East Plano Islamic Center এ রেসিডেন্ট স্কলার।

[iii] CSR ৪

[iv] CSR ১৪

[v] YK ১০৭-১০৮

[vi] পুরো থিসিস না অবশ্য। ফিতরার অংশ এত বেশি মজার ছিল যে আমি একটানাই পড়ে ফেলেছি।

[vii] Carl Sharif el-Tobgui, “Reason, Revelation & the Reconstitution of Rationality: Taqi al-Din Ibn Taymiyya’s (d. 728/1328) Dar’ Ta‘arud al-‘Aql wa-l-Naql” (PhD Dissertation, McGill University, 2013)

[viii] CSR ১৫

[ix] CSR ৭৯

[x] CSR ১০

[xi] CSR ১৩৫

[xii] শাইখ আকরাম নাদউই থেকে

[xiii] YK ৩১৭

[xiv] YK ৩২৩

[xv] YK ১৩১ (৭ নাম্বার পয়েন্ট)

[xvi] CSR ৫৪

[xvii] YK ১৩৮

[xviii] YK ১৯৯

[xix] YK ১৩৩

[xx] YK ১৪০

[xxi] YK ১৬৮

[xxii] YK ১৪১

[xxiii] CSR ১৭৭-২২৬

[xxiv] ibid

[xxv] একজন ‘আলিম যখন কোন কিছুকে হারাম বলেন, তখন সেটা খুবই সিরিয়াস একটা বিষয়। জন্মের পরের থেকে সবকিছু হারাম শুনতে শুনতে আমাদের কাছে এখন হারাম পানিভাত হয়ে গেছে। ইমাম শাফিয়ি এ পর্যন্ত বলেছিলেন যে জ্ঞানের মধ্যে হালাল-হারামের জ্ঞানের থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কোন জ্ঞান তার জানা নেই (আল-যাহাবী, তিব্ব আল-নাবাউই p. 119)। কুরআন থেকে বোঝার জন্য তাফসিরসহ সূরা আনআম ১৪৫-১৫৪ পড়ুন।

[xxvi] CSR ১৭৪

[xxvii] সোফিয়া ভাসালুর দেখা যেতে পারে: Sophia Vasalou, Ibn Taymiyya’s Theological Ethics (Leiden: Brill, 2016) pp. 56–105.

[xxviii] প্রাইম্যারিলি এমন হলেও আরও কিছু কথা আছে

[xxix] হামযা যর্টযিস এখানে যা লেখেছেন, ঈশ্বরেরে অস্তিত্ত্বের প্রমাণে ইবন তাইমিয়্যার দেওয়া ধারণা তার সাথে মিলে: https://www.islam21c.com/theology/does-one-need-to-prove-the-existence-of-god/

[xxx] YK ২৩৬

[xxxi] YK ৩২৭

[xxxii] YK ২৬৪; এর সাথে আবার বৈরাগ্যবাদকে মিলাবেন না, যৌক্তিক থাকেন।

[xxxiii] YK ২৭৭

[xxxiv] Zann কি সেটা কুরআন থেকে বুঝতে পড়ুন Nouman Ali Khan, “Assumptions” in Revive Your Heart (রিভাইভ ইয়োর হার্ট) (Kube Publishing, 2017. বাংলা অনুবাদঃ মারদিয়া মমতাজ, গার্ডিয়ান পাবলিকেশন্স, ২০১৯)

[xxxv] CSR ২৬৪

[xxxvi] M. M. Sharif, A History of Muslim Philosophy (Allgauer Heimatverlag, 1963)

[xxxvii] Ovamir Anjum, “Translator’s Introduction” in Ibn Qayyim al-Jawziyya, Ranks of the Divine Seekers: A Parallel English Arabic Text (Madarij al-Salikeen) (Brill, 2020) p. 4.

[xxxviii] CSR ৭৬; note 266

[xxxix] অবশ্য তলিবুল ইল্‌ম বলে পার্থক্য করাটা উচিত না। এখানে যারা রেগুলার পড়ালেখা করে তাদের বুঝিয়ছি আরকি।

--

--

Arman Firman

I focus on History of Science, Philosophy and Theology and its relationship with Islam. I also write on Western Study of Islam and Orientalism.