জেনারেল স্কলারলি ওয়ার্কে ইসলামের উল্লেখ ও আমাদের দোষ
মধ্যযুগীয় খৃষ্ট বিজ্ঞান নিয়ে একটা রিসার্চ পেপার পড়ছিলাম। জেনারাল ব্যাখ্যার পর পেপারের শেষে এসে কিছু অবদান আলোচনার সময় লেখক মেডিসিনের ক্ষেত্রে উল্লেখ করলেন যে মধ্যযুগে খৃষ্টান বিজ্ঞানীরা গ্যালেনের কাজের উপর বিল্ড করেছেন। কিন্তু আগের প্যারায় পিটার পেরেগ্রিনাস, ফ্রাইবার্গের থিওডোরিক, অ্যালবারটাস ম্যাগনাস যে ইবনুল হায়সাম, ইবনু রুশদদের কাজের উপর বিল্ড করেছেন, সেটা তিনি উল্লেখ করলেন না। যদিও কিছুক্ষণ আগেই যখন প্রথম ট্র্যান্সমিশনের আলাপ করছিলেন তখন প্রাচীন গ্রীকদের সাথে দিয়ে মুসলিম বিজ্ঞানীদেরও প্রশংসা করেন তিনি, শেষে এসে আর করার প্রয়োজন বোধ করলেন না।
যেটা বলতে চাচ্ছি এখানে, যদিও মুসলিমদের প্রাপ্য ক্রেডিট দেওয়ার সময় পপ্যুলার মিডিয়ার তুলোনায় অ্যাকাডিমিয়া অনেক ভালো অবস্থানে আছে, তবু ব্যাপারটা নরমালাইজ হয় নাই এখনো।
পেপারে লেখক যেমন শেষে এসে গ্যালেনের নাম নেওয়া স্বাভাবিক ভাবেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করলেন, কিন্তু ইবনুল হায়সামের নাম নিলেন না। তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলে ঠিকই উচ্ছসিত হয়ে বলে উঠবেন যে হ্যা, অবশ্যই এই খৃষ্টান বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের উপর মুসলিমদের প্রত্যাক্ষ প্রভাব পড়েছে। কিন্তু লেখার সময় মাথায় আসে না। জেনারালি বিজ্ঞানের ইতিহাস লেখার সময় প্রাচীন গ্রীকদের অবদান উল্লেখের কথা এমনিই মাথায় আসে, কিন্তু মুসলিমদের টা উল্লেখের সময় আলাদা মোটিভেশন প্রয়োজন পড়ে।
এই একইরকম চিত্র আপনি বর্তমানে অনেক বইয়ে দেখতে পাবেন। যেমন অক্সফোর্ডের ভিএসআই সিরিজের Philosophy of Religion বইয়ে ইশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে আলোচনা শুরুই হয়েছে ইমাম গাজালির দেওয়া আর্গ্যুমেন্ট পর্যালোচনার মাধ্যমে। আগে কোন জেনারাল বইয়ে মুসলিম চিন্তাবিদদের এমন গুরুত্ব দেওয়া হয় নাই কিন্তু। এটা ভালো, ওয়েস্টার্ণ অ্যাকাডেমিয়া অনেক ভালো অবস্থানে যাচ্ছে, তবে প্রতি ক্ষেত্রেই আপনার একটু গ্যাপ আছে বলে মনে হবে; খানিকটা খালি খালি লাগবে।
অ্যাকাডেমিক স্কলারদের নিজেদের লেখায় সামনে এই জিনিসটা ঠিক করতে হবে।
অবশ্য, এখানে আমাদের অর্থাৎ মুসলিমদেরও বড়সড় দোষ আছে। মুসলিম বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের অবদান নরমালাইজ করতে হলে এ বিষয়ে বিপুল পরিমাণে কাজ থাকা লাগবে। যেন জেনারাল স্কলারদের চোখে সেসব বারবার পড়ে ও মুসলিমদের অবদানের কথাটা তাদের মাথায় থাকে। কিন্তু আমরা হাই লেভেলের রিসার্চ বিপুল পরিমাণে আনতে পারি নাই, যার জন্য সেরা স্কলারদের প্রতি এটা আমরা নরমালাইজ করতে পারি নাই; অনেক ক্ষেত্রে তাদের তথ্যের প্রতি অ্যাক্সেসই দিতে পারি নাই আসলে।
হাওয়ায় ভাসা কথা বাদ দিয়ে একটা বাস্তব উদাহরণ দিই।
জন শেলেনবার্গ Monotheism and Rise of Science নামক ক্যাম্ব্রিজ এলিমেন্ট টা লিখেছেন। বইটিতে ইসলাম নিয়ে কোন কিছু থাকবে সেটা আশা করি নাই, থাকার কথা ছিল না। তবু ভিতরে ইমাম আশ’আরি কে নিয়ে একটা লাইন আছে।
প্রফেসর শেলেনবার্গের ইসলামি ধর্মতত্ত্বের সাথে কোন সম্পর্ক নাই। তিনি ধর্মের দর্শন নিয়ে কাজ করেন, অত্যন্ত প্রভাবশালী কিছু তত্ত্ব দিয়েছেন, কিন্তু কোনো দিক থেকেই ইসলামের সাথে কানেকশান নাই। তারপরও একটা জেনারাল বই, Science and Religion: A Historical Introduction এ ইসলামের এন্ট্রি পড়ে তার কাছে ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং লেগেছে এবং নিজের কাজে তিনি একটা তথ্য অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এন্ট্রিটা লেখতে দেওয়া হয়েছিল আলনুর জানানি নামক একজন স্কলার কে, যিনি The Physical Theory of Kalām: Atoms, Space, and Void in Basrian Mu’tazilī Cosmology বই লেখে ইসলামি ধর্মতত্ত্বের ক্ষেত্রে অ্যাকাডিমিয়ায় নিজের জন্য একটা সম্মানজনক পজিশন সৃষ্টি করেছেন।
এখানে দুইটা পয়েন্ট। এক- আলনুর জানানি না থাকলে, তিনি যদি পূর্বে হাই কোয়ালিটি কোন বই না লেখতেন, তাকে আর্টিকেল টা লেখার জন্য ডাকা হত না। হয়তো Science and Religion বইটাতে ইসলাম নিয়ে কোন এন্ট্রিই থাকতো না, যেমন অসংখ্য ধারাবাহিক প্রবন্ধ সংকলন গ্রন্থে নাই। যার ফলে শেলেনবার্গ তার বইটাতে ইসলামের নামই নিতেন না।
এই ধরণের প্যাটার্ন এর ক্ষেত্রে, জেনারাল স্কলারলি ওয়ার্কে মুসলিমরা যথাযথ গুরুত্ব পাওয়া তো দূর, একটা মেনশনও পেত না।
দুই- শেলেনবার্গ যেটা লেখেছেন সেটা আসলে একটা নেগেটিভ পয়েন্ট। তিনি যদি ইসলামি ধর্মতত্ত্বের উপর স্কলারদের আলাদা কাজ স্টাডি করতেন, যেমন যদি ফ্র্যাংক গ্রিফেলের কাজ পড়তেন, তাইলে এই ভুল হত না। কিন্তু আগে যেমন বলেছি, ইসলামি ধর্মতত্ত্বের সাথে শেলেনবার্গের কোন সম্পর্ক নাই। তিনি ধর্ম ও বিজ্ঞানের ইতিহাস নিয়ে স্টাডি করছিলেন, একটা এন্ট্রি সেখানে পেয়েছেন, যে এন্ট্রি লেখেছে সে ইসলামি ধর্মতত্ত্বের উপর একজন প্রতিষ্ঠিত স্কলার বলে খ্যাত, সে যেমন লেখেছে শেলেনবার্গ তেমন তুলে দিয়েছেন।
এই ধরণের প্যাটার্নের ক্ষেত্রে, জানানির জায়গায় যদি আরও ভালোমানের কোন স্কলার থাকতো, তাহলে সে সঠিকটা উপস্থাপন করতো আর শেলেনবার্গের বইয়েও সঠিক তথ্য টা আসতো, যা হত একটা পজিটিভ পয়েন্ট।
কানেকশান দেখতে পাচ্ছেন?
ওয়েস্টার্ণ অ্যাকাডিমিয়ায় মুসলিম বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিকদের নিয়ে যত কাজ হয়েছে, তার ৮০%ই নন-মুসলিমদের করা। তাই যতটুকু কাজ হয়েছে, যার জন্য জেনারাল অ্যাকাডেমিক বইগুলোর ভালোই উন্নতি হচ্ছে এক্ষেত্রে, তার পরিমাণ দেখে আমরা পরমভাবে খুশি হতে পারি না আসলে। কারণ এগুলো তো আমরা করিনি। আমরা মুসলিমরা তো করি নাই। কাজগুলো দেখে আমাদের খুশি হওয়া উচিত একদিকে, যে আমাদের ইন্টেলেকচুয়াল ট্রেডিশন ও কালচারাল প্রোডাকশন মরে না গিয়ে জীবিত থাকছে; তবে আবার অন্যদিকে অনুতাপ হওয়া উচিত, যে এটা তো আমাদের মুসলিমদের অবদান না। আমাদের রক্তগরম হওয়া উচিত। এটা দিয়ে নিজেকে ইনস্পায়ার করা উচিত স্টাডির জন্য, যেন পরিশ্রম করে যতটুকু গ্যাপ বাকি আছে ততটুকু ফিল করাতে ছোট হলেও একটা অবদান রাখতে পারি।