কুম্ভিলক কোপার্নিকাস

Arman Firman
9 min readJan 31, 2020

তখন ১৯৫৭ সাল। অটো নইগিবাউয়ার, একজন উঁচুমানের জার্মান বিজ্ঞানের ঐতিহাসিক, কোপার্নিকাস এর গাণিতিক জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে কাজ করছিলেন। এক বিশাল ভুল হয়ে যায় তার, আর তিনি আবিষ্কার করেন ইবন আল-শাতিরের একটি পুস্তিকা, যা তাত্ত্বিক জ্যোতির্বিদ্যা আলোচনা করে। তিনি অদ্ভুতভাবে ইবনুল শাতিরের চন্দ্র মডেলের সাথে কোপার্নিকাস এর চন্দ্র মডেলের হুবুহু মিল দেখতে পান, একদম প্রতিটি ক্ষেত্রে[i]। উল্লেখ্য, নইগিবাউয়ার অ্যারাবিক পারতেন না। তবু দুটির মধ্যে মিল এত বেশি ছিল যে, বুঝতে ভাষা লাগে না।

তার বন্ধু, এডওয়ার্ড কেনেডিও ভুলক্রমে একই ররকম একটি টেক্সট এর সন্ধান পেয়েছিলেন বিখ্যাত বোডলেইন লাইব্রেরিতে। দুজনের মধ্যে এ ব্যাপারে বিস্তর আলোচনা হল। ফলস্বরুপ জন্মলাভ করল ব্যাপারটার প্রথম রিসার্চ পেপার “The Solar and Lunar Theory of ibn al-Shatir: A pre-Copernican Copernican model”। এটি লিখেছিলেন কেনেডি এর স্ট্যুডেন্ট, ভিক্টর রবার্ট্‌স। এরপর কি আর, ধীরে ধীরে বিজ্ঞানের ইতিহাস অ্যাকাডেমিয়ায় বোম ফাটল।[ii]

একজন ইসলামিক সায়েন্টিস্ট এর সাথে কোপার্নিকাস এর কাজ হুবুহু মিলে যাওয়া খুবই অস্বাভাবিক। কোন চাইনিজ বা ভারতীয় সায়েন্টিস্ট এর সাথে মিললে কেউ বেশি একটা পাত্তা দিত না। কিন্তু ইসলামিক অ্যাস্ট্রনমি তো তখন সমগ্র ইউরোপে স্টাডি করা হত, বিশেষ করে ক্রাকো ইউনিভার্সিটিতে (যেখানে কোপার্নিকাস পড়েছেন) সেটা ছিল বাধ্যতামূলক![iii] তাই নইগিবাউয়ার আরও মিল খুজতে লেগে গেলেন। কিন্তু সেটা ছিলেন উইলি হার্টনার, যিনি ১৯৭৩ সালে এক অবিশ্বাস্য মিল খুঁজে পেলেন কোপার্নিকাস আর নাসির আল-দ্বীন তুসীর মাঝে।

নাসির আল-দ্বীন তুসীর এক বিখ্যাত উপপাদ্য আছে, Tusi Couple — যা ব্যবহার করে বৃত্তীয় গতি থেকে সরলরৈখিক গতি পাওয়া যায়। এটি কোপার্নিকাস তার De Revolitionibus বইয়ে ব্যবহার করেছিলেন। এর জন্য তিনি আল-তুসীর মতোই একটি প্রমাণ দিয়েছিলেন। যাহোক, শক হচ্ছে, যেখানে নাসির তুসী কোন বিন্দুর নামকরণ আরবী ا (আলিফ) দিয়ে করেছেন, সেখানে আলিফের সমমানের ল্যাটিন অক্ষর ‘A’ ব্যবহার হয়েছে কোপার্নিকাসের প্রমাণে। যেখানে আরবী ب (বা) সেখানে ল্যাটিন ‘B’। যেখানে د (দাল) সেখানে ‘D’ এবং অন্যান্য সব ক্ষেত্রে একই — অ্যারাবিক বর্ণের জায়গায় সমমানের ল্যাটিন বর্ণ![iv]

শুধু একটি পার্থক্য আছে, অবশ্য। যেখানে ز (যা) ব্যবহার হয়েছে, সেখানে কোপার্নিকাসের ডায়াগ্রামে আছে F। কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অ্যাওয়ার্ড উইনিং বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদ জর্জ স্যালিবা বিষয়টি ভাল ভাবে পর্যবেক্ষণ করে বলেছেন যে, এটি কোপার্নিকাসের, আল-তুসীর থেকে সাহায্য নেওার ব্যাপারটাকে আরও শক্ত করে। কিভাবে? এ থেকে সিমপ্লি বোঝা যায় যে, কোপার্নিকাস বা তিনি যার থেকে সাহায্য নিয়েছিলেন সে অ্যারাবিকে বেশি অভিজ্ঞ ছিল না এবং ز কে ভুলবশত ف হিসেবে নেয়। । অনভিজ্ঞ কারোর জন্য ‘যা’ কে ‘ফা’ পড়া সহজ একটা ব্যাপার।[v]

এবার আগমন হবে মুওয়াইদদ্বীন আল-উর্দীর। তার উপপাদ্য Urdi’s Lemma নামে পরিচিত। এটি ইবন আল-শাতির তার মডেলে ব্যবহার করেছিলেন। কোপার্নিকাসও এটি তার মডেলে ব্যবহার করেন। কিন্তু — এটার জন্য কোপার্নিকাস কোন প্রমাণ উপস্থাপন করেননি। পরবর্তীতে কেপলার এটার প্রমাণ না পেয়ে হতবুদ্ধি হন এবং তার শিক্ষক মেস্টলিন কে এ ব্যাপারে লিখে পাঠান। তখন মেস্টলিন এটার প্রমাণ প্রতিপাদন করেন। সেটা অবশ্য শুধু সে মডেলে যা প্রয়োজন ছিল সেটুকু প্রমাণ, সমস্ত উর্দির লেমার প্রমাণ না। যাহোক, এখানে কিছু বুঝেছেন কি? কোপার্নিকাস, ইবনুল শাতিরের মডেল পর্যবেক্ষণ করছিলেন এবং সেখান থেকে হুবুহু কপি করেন। আর প্রায় ‘না জেনে’ উর্দির লেমা-ও কপি করে ফেলেন।[vi]

অ্যাস্ট্রোনমি এর হিস্ট্রির বড় নাম, নোয়েল সোয়ার্ডলো অভিমত দিয়েছেন যে, কোপার্নিকাস তার মডেলের সাথে বুধ গ্রহের (Mercury) আপাত গতির সম্পর্ক জানতেন না। এক্ষেত্রে, কোপার্নিকাস, ইবনুল শাতির থেকে না বুঝেই কপি-পেস্ট করেছেন। তিনি নিজেও জানতেন না যে তিনি কি লিখছেন! শুধু পার্থক্য হচ্ছে ইবনুল শাতির নিজ মডেলে হিলিওসেন্ট্রিক বৈশিষ্ট্য অ্যাপ্লাই করেননি।[vii] এটাই কোপার্নিকাস আর ইবনুল শাতিরের লুনার মডেলের মধ্যে একমাত্র পার্থক্য যে, মুসলিমদের পৃথিবী মহাকাশে স্থির আর কোপার্নিকাস এর পৃথিবী সূর্যকে আবর্তন করছে।[viii] লুনার মডেলের বাকি অংশ হুবুহু একই।

বর্তমান বিজ্ঞানের ইতিহাস অ্যাকাডেমিয়ায় কোপার্নিকাসের একাধিক মুসলিম বিজ্ঞানীদের থেকে নেওয়ার ব্যাপারটা প্রতিষ্ঠিত এবং এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। স্যালিবা, নইগিবাউয়ার, সোয়ার্ডলো, হার্টনার, বার্কার আর অ্যারিউ, হুগোনার্ড-রশ, ওয়েস্টম্যান, কোহেন, চিচেস্টার এবং অন্যান্য সকল জ্যোতির্বিদ্যার ইতিহাসবিদ (কিছু ইনট্রানসিজেন্ট মানুষ বাদে) একমত যে কোপার্নিকাস মুসলিম বিজ্ঞানীদের থেকে নিয়েছেন, আর মুসলিমদের থেকে নেওয়া ছাড়া তার নিজের পক্ষে হিলিওসেন্ট্রিক মডেল উপস্থাপন করা একেবারেই অসম্ভব ছিল।[ix] These are probably coincidences বলার কোনোরকম সুযোগ এখানে নেই।

সুতরাং এখন প্রশ্ন এটা না যে ‘যদি কোপার্নিকাস নিয়ে থাকেন’ বরং প্রশ্ন হচ্ছে ‘কখন কোপার্নিকাস নিয়েছেন’ এবং ‘কিভাবে কোপার্নিকাস নিয়েছেন’। শেষোক্ত দুটি প্রশ্নের উপর এখন কিছু বাক্য ব্যায় হবে। কেননা ট্র্যান্সমিশন রুট ছাড়া বিজ্ঞানের ইতিহাসে কাজ চলে না।

কোপার্নিকাস গ্রীক আর ল্যাটিন পারতেন, কিন্তু অ্যারাবিক তিনি পারতেন — এমন কোন প্রমাণ নেই।[x] সুতরাং তিনি সরাসরি পড়েছেন — এমন ধারণা অগ্রহণযোগ্য। এক্ষেত্রে আমাদের কাছে আছে শুধু কিছু সম্ভাবনা। ইতিহাসের প্রথম ওরিয়েন্টালিস্ট, গুইয়াউম পোস্টেল — যিনি কোপার্নিকাসের সময়কার, নাসির তুসীর কাপল এর প্রমাণসহ অনুবাদ করেছিলেন।[xi] কিন্তু কোপার্নিকাস এর সংস্পর্শে এসেছিলেন কিনা তার কোন প্রমাণ নেই। রোমের ভ্যাটিকান লাইব্রেরীতে নাসির তুসীর উপপাদ্য পাওয়া যেত। কিছু বিজ্ঞানের ঐতিহাসিকের মতে, কোপার্নিকাসের সেখানে যাওয়া সম্ভব এবং হয়তোবা তেমনই ঘটেছে।[xii] আবার আন্দ্রেয়াস আল্পাগাস (আন্দ্রেয়া আল্পাগো) ১৫ বছর ধরে (অন্য মতে ৩০ বছর) সিরিয়ায় কাটিয়েছেন অ্যারাবিক সায়েন্টিফিক টেক্সট অনুবাদ করার উদ্দেশ্যে। খুব স্বাভাবিকভাবেই তার ইবনুল শাতিরের ব্যাপারে জানার কথা, যে তার ১০০ বছর আগে ছিল। যথেষ্ট প্রমাণ আছে যে কোপার্নিকাসের সময় অসংখ্য অ্যারাবিস্ট ইউরোপের বিভিন্ন শহরে উপস্থিত ছিলেন।[xiii] ইতালিতেই, আসলে, নাসির তুসীর কাপল এর অসংখ্য পাণ্ডুলিপি পড়ে আছে আর খুব স্বাভাবিক ভাবেই সেগুলোর যেকোনো একটি কোপার্নিকাস পেয়ে থাকতে পারেন।[xiv] আবার তিনি পাদুয়ায় গিয়েছিলেন পড়ালেখা করতে, যেখানে ১৬শ শতকে অনেক অটোমান মুসলিম পড়ালেখা করত[xv]। যদিও কোপার্নিকাসের গমনের টাইমের সাথে ঐ সময় মিলে কিনা নিশ্চিত না, তবু, যদি দেখা হয়ে থাকে তো তাদের থেকে জানতে পারেন এবং তাদেরই ব্যবহার করে কোপার্নিকাস অনুবাদ করিয়ে নিতে পারেন। তবে আরও বড় প্রমাণ যেটা পাওয়া যায়, কোপার্নিকাস যখন ক্রাকো ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষারত ছিলেন, তখন অ্যালবার্ট ব্রাযিউস্কি সেখানে লেকচারার ছিলেন। ব্রাযিউস্কি নাসির তুসী আর ইবন আল-শাতিরের গাণিতিক প্রক্রিয়া ব্যবহার করেছিলেন যা পরবর্তীতে কোপার্নিকাসের ব্যবহার করা প্রক্রিয়ার সাথে মিলে।[xvi] সুতরাং হয়ত কোপার্নিকাস এর অধায়নকালে ক্রাকো ইউনিভার্সিটিতে নাসির তুসী আর ইবনুল শাতিরের কাজ পাওয়া যেত[xvii]। আর ইবনুল শাতিরের কাজ মানে আল-উর্দির কাজও পেয়ে যাওয়া। এমন হলে হিসাব ক্লিয়ার। তবু, এই দুটি প্রশ্নের খুবই নিম্নমানের স্টাডি হয়েছে।[xviii] এজন্যই তথ্যের ক্ষরার মধ্যে আছি আমরা। কিন্তু জর্জ স্যালিবা একদম নিশ্চিত যে ভবিষ্যতের গবেষণা ট্র্যান্সমিশন রুট বের করে ছাড়বে। অবশ্য তিনি এসব বলেছেন ২০০৭ সালে। এমনিতেই ট্র্যান্সমিশন অংশ অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে, আর বাড়াব না। পরে ভালো কিছু কাজ নজরে পড়েছে, সেসব পড়িনি। এতটুকু লেখতেই মাথার তার সব ছিঁড়ে যাচ্ছে…এর জন্য আলাদা আর্টিকেল লাগবে :)

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কোপার্নিকাস কে কি সরাসরি চোর বলা উচিত? তিনি কি কষ্ট করেননি? তিনি কি গভির চিন্তা করেননি? তিনি কি সেরা কাজ করেননি তখন? তার মত একজন মানুষকে কি সরাসরি এমন আক্রমণ করা উচিত? আমিও কোপার্নিকাসের ফ্যান ছিলাম। ছোটবেলা যেমন জেনেছিলামঃ নিজের জীবন বাজি রেখে কোপার্নিকাস সত্য উদ্ঘাটন করেন, ‘ধর্মের অন্ধবিশ্বাস হেরে যায় বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণের কাছে’। এই ধারণাই আমাদের নবম-দশম শ্রেণীর ফিজিক্স পাঠ্যবইয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এখন আর কি করতে পারি, কোপার্নিকাসের ক্ষেত্রে ‘কুম্ভিলক’ থেকে ভালো কোন শব্দ আমার জানা নেই। কোপার্নিকাসের অসৎ চরিত্র অতি সহজে দৃষ্ট।

কোপার্নিকাস তার কাজে অনেক মুসলিম বিজ্ঞানীদের নাম নিয়েছেন, বিশেষ করে আল-বাত্তানীর উপর নির্ভর করেছেন তিনি বেশি। সাথে দিয়ে আছেন সাবিত ইবন কুররা, আল-যারকালী, আল-বিত্রুজী, ইবন রুশদ। এরা হল সেসব বিজ্ঞানী, যাদের জ্যোতির্বিদ্যা ইউরোপ জুড়ে পড়ানো হত। সুতরাং তাদের নাম লুকানোর কিছু নাই। লুকালে সহজেই ধরা খেতেন কোপার্নিকাস। কেননা তাদেরকে ব্যবহার করা ছাড়া অ্যাস্ট্রনমি করা সম্ভব ছিল না। সবাই এমনিতেই বুঝত। কিন্তু মূল জায়গায়, যা কোপার্নিকাস কে একজন স্মরণীয় বিজ্ঞানী করে রাখে, সেই হিলিওসেন্ট্রিক মডেল, যার জন্য অনেক ঐতিহাসিক কোপার্নিকাসকে আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যার জনক, এমনকি আধুনিক বিজ্ঞানের জনক পর্যন্ত বলেছেন, সেই জায়গায় তিনি মুসলিম বিজ্ঞানীদের নাম নেননি। একদম পারফেক্ট চৌর্যবৃত্তি। আগে মুসলিমদের নাম নিয়েছেন, সবাই মনে করবে কোপার্নিকাস সৎ, পরে মেইন জায়গায় আর নেননি। তিনি কি আর চিন্তা করেছিলেন নাকি যে ৪০০ বছর পরেও এসব নিয়ে গবেষণা হবে! এমনকি প্রশংসা পাওয়ার লোভ, নিজের কাজকে অরিজিনাল দেখানোর লোভ এত বেশি ছিল যে, তিনি স্বজাতির বিজ্ঞানীর নামও মুছে দিলেন। পূর্বকার সময়ের মাত্র দুজন বিজ্ঞানীর নাম জানা যায় যারা হিলিওসেন্ট্রিক মডেল কে থিওরি হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন। যারা হলেন সূত্রপাতকারী সামোস-এর অ্যারিস্টার্কাস আর তার অনুসরণকারী সিলিউসাস[xix]। কোপার্নিকাস, অ্যারিস্টার্কাস এর নাম তিন বার নিয়েছেন তার ডে রেভোলুশোনিবাস এ, কিন্তু একবারও এটা উল্লেখ করেন নাই যে অ্যারিস্টার্কাস অনেক আগে হিলিওসেন্ট্রিক মডেলে বিশ্বাসী ছিলেন। এখানে আগের মত চালাক চৌর্যবৃত্তি। তিনি তার বইয়ে এমন কিছু গ্রীক ফিলোসফার এর নাম নিয়েছেন যারা হিলিওসেন্ট্রিক চিন্তা করেছিলেন। অনেকে বলে এটা নাকি কোপার্নিকাসের সত্যতা প্রমাণ করে! আরে, কোপার্নিকাস তো যে হিলিওসেন্ট্রিক মডেল কে থিওরি আকারে উপস্থাপন করেছিলেন তার নাম মুছেই দিয়েছেন, এখন শুধু সৎ হওয়ার ঢং করে চোখে ধূলা দেওয়ার প্রচেষ্টা। তার পাণ্ডুলিপিতে উল্লেখিত ছিল অ্যারিস্টার্কাস এর হিলিওসেন্ট্রিক ধারণার কথা, কিন্তু যখন বই পাবলিশ হয়, তখন সেটা কোপার্নিকাস মুছে দেন।[xx] আবার তার আগে কেন অ্যারিস্টার্কাস হিলিওসেন্ট্রিসিটির ধারণা করতে পারলেন, সেজন্য কোপার্নিকাস, অ্যারিস্টার্কাস এর উপর বিরক্ত ছিলেন।[xxi] বিখ্যাত লেখক ও ঐতিহাসিক জন ফ্রীলি তো সরাসরি বলেই দিয়েছেন যে কোপার্নিকাস এটি লুকিয়েছেন যেন তার নিজের কাজের ‘গুরুত্ব কমে না যায়’[xxii][xxiii] বুঝেন এবার অবস্থা! যে ক্রেডিটের লোভে পড়ে নিজ জাতির বিজ্ঞানীর নামই মুছে দেয়, সে অন্য জাতির বিজ্ঞানীর নাম রাখবে কিসের জন্য?

তবু বেশিরভাগ (এ পর্যন্ত আমার দেখা সব) বিজ্ঞানের ঐতিহাসিক কোপার্নিকাসকে রেভোল্যুশোনারি সায়েন্টিস্ট বলে উল্লেখ করেন। এমনকি আমি যার পাগলা ফ্যান, সেই জর্জ স্যালিবাও। সালাহ উদ্দিন জাযাইরীর মত মুসলিম বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদরা এমন অভিমত দেন।[xxiv] এ বলে যে, ‘হ্যা, কোপার্নিকাসের সেরা কাজ মুসলিম বিজ্ঞানীদের জ্যোতির্বিদ্যার উপর ভিত্তি করা, কিন্তু তারা তো জিওসেন্ট্রিক মডেলের গীতই গাইছিলেন নাকি? সেসব প্রমাণ নিয়ে এসে হিলিওসেন্ট্রিক মডেলের মত এত বড় একটা ডিসিশনে আসা তো বিশাল পদক্ষেপ’। তাদের মতে, এই Gestalt switch একটা নতুনত্ব। কিন্তু লক্ষ্য করুন, হিলিওসেন্ট্রিক মডেল অ্যারিস্টার্কাস এর কাজে ছিল, শুধু তার কাছে প্রমাণ ছিল না। প্রমাণ ইবনুল শাতিরদের কাছে ছিল, কিন্তু তারা জিওসেন্ট্রিক মডেল ছাড়তে প্রস্তুত ছিলেন না। কোপার্নিকাস জাস্ট দুটো জিনিস মিলিয়েছেন। অবশ্য এ দুটো মেলাতে গেলেও অনেক খাটতে হয় আর জ্যোতির্বিদ্যায় ভালো দক্ষতা থাকা লাগে। এখানে কোপার্নিকাসের কৃতিত্ব হল, এই পুনঃচিন্তা যে হিলিওসেন্ট্রিক মডেলই আসলে ঠিক।

তবে প্রশংসা করতে হয় কোপার্নিকাসের তথ্য বের করার প্রচেষ্টার আর তার সাহসের। মুসলিমদের কাজ এমন উৎস থেকে বের করেছেন, যা বর্তমানের বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদগণ খুজে বের করতে পারছেন না। আর চার্চের ভয়ংকর মূর্তির সামনে সত্য উদ্ঘাটন করেছেন। এই কাজের জন্য তাকে ‘সর্বকালের সবচেয়ে প্রভাবশালী মানুষদের একজন’ বলা যেতে পারে, কিন্তু ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের একজন’ বলা, আমার মনে হয় না ঠিক। তার অন্যান্য কাজ থাকতে পারে, কিন্তু যেই কাজের জন্য তার ভূয়সী প্রশংসা, যার জন্য তাকে আধুনিক বিজ্ঞানের জনক পর্যন্ত বলা দেওয়া হয়, সে কাজ বড় কিছু না। তার রেজাল্ট অবশ্যই বিশাল, কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় কোপার্নিকাস সেটা করেছেন, সেটি বড় কিছু না। হ্যা, এটা করতে জ্যোতির্বিদ্যায় চরম দক্ষতা লাগে, কিন্তু সেটাতো অন্য সাধারণ অ্যাস্ট্রনমারও করতে পারতেন নাকি?

কোপার্নিকাস তার কাজে পূর্বের অসংখ্য বিজ্ঞানী থেকে সাহায্য নিয়েছেন, যেমনঃ উপরে উল্লেখিত মুসলিম বিজ্ঞানীগণ, রেজিওমন্ট্যানাস, পিউরব্যাক, টলেমি ইত্যাদি — আর এটা একেবারেই স্বাভাবিক। বিজ্ঞানের নিয়মই এটা, পূর্বের বিজ্ঞানীদের থেকে নিয়ে নিয়েই নতুন জিনিসের আবির্ভাব হয়। কোন কিছু আকাশ থেকে পড়ে না। কিন্তু সমস্যা সে জায়গায় যে জায়গায় কোপার্নিকাস মুসলিমদের নাম নেননি, সেই মূল জায়গায়। সমস্যা সেখানে, যেখানে কোপার্নিকাস, অ্যারিস্টার্কাস এর নাম মুছে দিয়েছেন। এটাই চৌর্যবৃত্তি এবং এটা ভয়ানকভাবে কোপার্নিকাসকে কলঙ্কিত করে। কোপার্নিকাস সিরিয়াস ট্যালেন্টেড মানুষ ছিলেন। আইনে ডক্টরেট করেছেন, প্র্যাক্টিস করতেন মেডিসিন আর বোম ফাটিয়েছেন অ্যাস্ট্রনমিতে! কোপার্নিকাস একজন জিনিয়াস ছিলেন, তার কাজে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অরিজিনালিটি অবশ্যই আছে, আছে গভির চিন্তার ছাপ। কিন্তু তাকে (বিজ্ঞানী হিসেবে) যে পরিমাণে উপরে তোলা হয়, তা, আমার মতে কোনভাবেই ঠিক নয়। তাকে সূর্যে পাঠানোর দরকার নেই, বরং পৃথিবীর মাটিতে রাখাই উত্তম।

বর্তমান সময়ের বেশিরভাগ বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদরা কোপার্নিকাসকে রেনেসাঁ এর প্রথম বিজ্ঞানী না, বরং মারাগা অ্যাস্ট্রোনমিকাল ট্র্যাডিশন এর অন্তিম বিজ্ঞানী বলে থাকেন। নাসির আল-দ্বীন তুসী যে ধারা শুরু করেছিলেন, তার পরিসমাপ্তি ঘটান কোপার্নিকাস। কোপার্নিকাস মারাগা স্কুল এর শেষ বিজ্ঞানী আর গ্যালিলেও বরং আধুনিক পিরিয়ডের প্রথম বিজ্ঞানী।[xxv]

:) পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষের ধারণা কোপার্নিকাস এক মহাবিশাল কাজ করেছেন। চিত্রকর ইয়ান মাটেইকো তো ‘Copernicus’s Conversations with God’ নামে এক চিত্রই একে ফেলেছেন, এই ভেবে যে ঈশ্বরের সাথে আলাপ ছাড়া এই গভির তত্ত্ব বের করা অসম্ভব! যদি চিত্রকর সাহেব জানতে পারতেন যে মুসলিম বিজ্ঞানীদের থেকে মেরে দিয়ে কোপার্নিকাস তত্ত্বটি সাজিয়েছিলেন, তবে ইসলাম গ্রহণ করতেন নাকি?[xxvi]

Notes and References:

[i] Seyyed Hossain Nasr, Science and Civilization in Islam (ABC International Group, Inc. 2001)

[ii] George Saliba, Islamic Science and Making of European Renaissance (The MIT Press, 2007) p. 196

[iii] Salim T. S. al-Hassani (edt), 1001 Inventions: The Enduring Legacy of Muslim Civiliazation (4th Edition, ebook, 2017)

[iv] George Saliba, Islamic Science op. cit. p. 199

[v] George Saliba, Islamic Science op. cit. 200; George Saliba. “Embedding Scientific Ideas as a Mode of Science Transmission” muslimheritage.com

[vi] George Saliba, Islamic Science op. cit. p. 205

[vii] George Saliba, Islamic Science op. cit. p. 209

[viii] Salim T. S. al-Hassani (edt), 1001 Inventions op. cit. loc. 4788

[ix] Noel Swerdlow, “Astronomy in the Renaissance,” in Christopher Walker (edt) Astronomy before the Telescope, (St. Martin’s Press, 1996) pp. 187–230, p. 202.

[x] George Saliba, Islamic Science op. cit. p. 214

[xi] George Saliba, Islamic Science op. cit. p. 217

[xii] Howard R. Turner, Science in Medieval Islam: An Illustrated Introduction (University of Texas Press, 2006) p. 69

[xiii] George Saliba, Islamic Science op. cit. p. 221

[xiv] Jim al-Khalili, Pathfinders (Allen Lane, 2010) loc. 4297

[xv] Ekmeleddin Ihsanoglu. “The History of Scientific Interaction” muslimheritage.com

[xvi] John Freely, Light from the East: How the Science of Medieval Islam Helped to Shape the Western World (I. B. Tauris, 2011) p. 172

[xvii] John Freely, Before Galileo: The Birth of Modern Science in Medieval Europe (Overlook Duckworth, 2013) loc. 3022

[xviii] George Saliba, Islamic Science op. cit. p. 220

[xix] Jim al-Khalili, Pathfinders op. cit. loc. 4089। এখানে উল্লেখ্য, যে একজন মুসলিম বিজ্ঞানীও ছিলেন যিনি হিলিওসেন্ট্রিক মডেল উপস্থাপন করেছিলেন — আল-সিজযী। কিন্তু তার ব্যাপারে বেশি জানা যায় না।

[xx] John Freely, Light from the East op. cit. p. 178

[xxi] Jim al-Khalili, Pathfinders op. cit. loc. 4306

[xxii] John Freely, Light from the East op. cit. p. 179

[xxiii] কোপার্নিকাস অ্যারিস্টার্কাসের ব্যাপারে জানতেন না — এটা একেবারেই ভিত্তিহীন কথা। এটা বিজ্ঞানের ইতিহাস মহলে ভালোভাবেই প্রতিষ্ঠিত যে কোপার্নিকাসের সময়ের ইউরোপিয়ানরা অ্যারিস্টার্কাসের ব্যাপারে জানত আর কোপার্নিকাসও জানতেন (J. al-Khalili, 4306)।

[xxiv] S. E al-Djazairi, The Hidden Debt to Islamic Civilization (MSBN Books, 2018)

[xxv] Jim al-Khalili, Pathfinders op. cit. loc. 4348

[xxvi] “বিজ্ঞানের ইতিহাস আলোচনার মাঝে ইসলাম ঢুকাচ্ছেন ক্যান” যদি কারো মনে এমন প্রশ্ন জাগে, তাইলে বলে দিচ্ছি, মুসলিম বিশ্বের বিজ্ঞানের ইতিহাসের সাথে ইসলাম ওতপ্রোত ভাবে জড়িত।এখানের বিজ্ঞানীদের যদি দেখেন, ইবনুল শাতির মসজিদে নামাযের সময় বের করার কাজ করতেন, মুওয়াইদদ্বীন উর্দি অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ মুসলিম ছিলেন যা তার লেখা দেখলে বোঝা যায়। নাসির আল-দ্বীন তুসীর বই শি’ই আক্বিদায় আজ পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়।

--

--

Arman Firman

I focus on History of Science, Philosophy and Theology and its relationship with Islam. I also write on Western Study of Islam and Orientalism.